1. nasiralam4998@gmail.com : admi2017 :
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৮:৫৮ অপরাহ্ন

একটি কালো মেয়ের কথা : মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩
  • ১৫৫ বার

বাংলা কথাসাহিত্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮) এবং ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮) পৃথকভাবে আলোচনাযোগ্য। তাঁরা প্রত্যেকে অমর হয়ে আছেন সাহিত্যকর্ম দিয়ে। পাশাপাশি সময়ে তাঁদের জন্ম এবং তাঁরা তিনজনই সাহিত্যের ক্যানভাসে গ্রামবাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবনচিত্র নিখুঁতভাবে এঁকেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি স্থান দখল করেছে রাঢ়বঙ্গের প্রান্তিকজন এবং জনপদ। যে জনপদে পরবর্তীকালে হেঁটেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।

অনস্বীকার্য যে, বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্করকে বাদ দিয়ে সাহিত্যালোচনা ফিকে হয়ে যাবে। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার শুধু বিপুল নয়, ধ্রুপদী ধারার সাহিত্য সৃষ্টি করেও তিনি বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি ভারতীয় লেখক। তবে কেবল ভারতের বাংলাভাষাভাষী সাহিত্যানুরাগীদের কাছে নন, বাংলাদেশেও তিনি সমান জনপ্রিয় এবং সাহিত্যিক-মর্যাদা লাভ করেছেন। তাঁর একটি অমূল্য সাহিত্যকর্ম এই নিবন্ধের বিষয়।

ভাষার টানেই নাড়ির টান, শেকড়ের টান তো আছেই— সাতচল্লিশে পেন্সিলে কাটা মানচিত্র ভাগাভাগি হলেও সব বাঙালির নাড়ির টান কি কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায়? দু’দেশের জনগণের পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিকদের অন্তরাত্মার টান যে কতটা নিবিড় তার প্রমাণ লেখার মধ্যেই পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালের শয্যায় শায়িতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মানুষদের প্রতি অমোঘ দরদ ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ নামে নাতিদীর্ঘ উপন্যাস লেখেন। উপন্যাসটি লেখার কিছু দিন পরেই তিনি দেহত্যাগ করেন। ফলে প্রকাশিত অবস্থায় তিনি এটি দেখে যেতে পারেননি। উল্লেখ্য যে, সে বছরের নভেম্বর মাসে বইটি প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ থেকে ডেইলি স্টার বুকস প্রকাশনা থেকে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। সাহিত্যকে লেখক জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলেই রোগশয্যায়, বলতে গেলে মৃত্যুশয্যায় থেকেও দুটি উপন্যাস লিখে বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর দুটি উপন্যাসের মধ্যে একটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। অন্যটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ‘সুতপার তপস্যা’। লেখকের শেষ ইচ্ছানুযায়ী এক মলাটে ‘১৯৭১’ নামে দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। একই বছর ১৪ই সেপ্টেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। রেখে যান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘একটি কালো মেয়ের কথা’।

এটি ৯০ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। কাহিনি শুরু হয় উপন্যাসের নায়কের চোখের বর্ণনা দিয়ে, যে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে গভীর রাতে ঢাকায় ক্র্যাক ডাউনের পরের দিন ঢাকা শহরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও সারি সারি বীভৎস রক্তাক্ত লাশ দেখে দিশেহারা। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তে পাকিস্তানের গুপ্তচর সন্দেহে ইন্টারোগেশনের জন্য তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেড় পৃষ্ঠার প্রথম অধ্যায়ে পাকিস্তানের গুপ্তচর সন্দেহের চরিত্রের নামোল্লেখ না করে নাটকীয় ও রহস্যময় চোখের বর্ণনার মাধ্যমে পাঠককে আটকানো হয় এবং পরের প্রতিটি অধ্যায়ে পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সন্দেহভাজন গুপ্তচর (যদিও সে গুপ্তচর নয়) ডেভিড ঢাকার অপারেশন সার্চ লাইটের ভয়াবহ বর্ণনাসহ তার জীবনের কাহিনি এবং নাজমার সঙ্গে জড়ানোর ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে উন্মোচন করে। ছোট-বড় মোট সতেরোটি অধ্যায়ের মধ্যে আখ্যানটি রচিত হয়েছে।

উপন্যাসের মূল কথক রেডিও ম্যাকানিক্স ভাগ্যবিড়ম্বিত ডেভিড হলেও তার সমস্ত বক্তব্য গৃহীত হয়েছে থানার দুজন পুলিশের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে। থানায় স্থানীয় যুবক যারা তাদের গুপ্তচর সন্দেহে ধরেছে তারাও সেখানে উপস্থিত ছিল।

ভারতীয় পুলিশের এক প্রশ্নের উত্তরের ডেভিডের বর্ণনায় উঠে আসে লাশ আর লাশ দেখে ঢাকায় থাকা নিরাপদ মনে না-করাতে জীবন বাঁচানোর জন্য সে এবং নাজমার দুই বছরের ছেলেসহ তিনজন গোপন পথে ভারতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। পথে নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে গেলে ডেভিডের চেহারা দেখে তাকে গুপ্তচর সন্দেহে সীমান্ত এলাকার কয়েকজন তরুণ ডেভিড ও নাজমাকে থানায় সোপর্দ করে। সে স্পাই নয় প্রমাণ করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে এবং বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষার মিশ্রণে চলতে থাকে কথোপকথন। এভাবেই উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে যেতে থাকে।

‘তুমি কি পাকিস্তানী নও?’ পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ডেভিড যা বলেছে তাতে সন্দেহ আরও দানা বাঁধে। ডেভিড বুঝাতে চেয়েছে যে, চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তানের দানাপানি খেয়ে বড়ো হয়েছে তাহলে কীভাবে সে পাকিস্তানি নয়? তখনই স্থানীয় এক যুবক তার গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে উদ্ধত কণ্ঠে গালাগাল দেয়। তবে ডেভিড সহজে ওই যুবকের রূঢ় আচরণ ও থাপ্পড় মেনে নেয়নি। সে প্রতিবাদ করে জানতে চায়- কেন তাকে মারা হয়েছে? পোশাক ও চেহারার পাশাপাশি ডেভিড ইংরেজি, উর্দু ও বাংলার ভাষার মিশ্রণে কথা বলার কারণেও তাকে স্পাই সন্দেহ করাটা অমূলক নয়। ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা ও যুবকরা ভালোভাবেই জানে যে, সাধারণত বাঙালিরা এভাবে মিশ্রিত ভাষায় কথা বলে না।

ডেভিড আর্মস্ট্রং একজন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান যার বাবা ছিলেন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান এবং মা বাঙালি খ্রিষ্টান। স্বপ্নবিলাসী বাবা ছিল ইয়ার্ড অফিসার আর মা হাসপাতালের নার্স। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তারা করাচি চলে যায় কিন্তু কিছু দিন পর মা মারা যায়। ডেভিডের বর্ণনায়:
“মা হঠাৎ হার্টফেল ক’রে মারা গেল, বাবা আবার বিয়ে করলে শুকনো চেহারার নিষ্ঠুর মেজাজের এক আধবুড়ী খাস মেমসাহেবকে and I was left alone, a forsaken child সারি দুনিয়ামে মেরা কোই নেহিথা! অবশ্য child তখন আর আমি নই। বয়সে পনের পার হচ্ছি দুনিয়ার একটা আলাদা টান মনকে টানতে শুরু করেছে। জিন্দেগীর অনেক মন্দ জিনিস গোপনে গোপনে জেনিছি। রাত্রে মিশন থেকে বেরিয়ে পালাতে গিয়ে ধরাও পড়েছি দু-চারবার। গানের গলা ছিল-সিনেমার গান শিখেছি। উর্দু গান ভাল লাগছে। গজল গাই। এসব ফাদারদের অজানা ছিল না। এর উপর বাবা হঠাৎ চলে গেল- আমার খরচের জন্য এক পয়সাও দিয়ে গেল না। তবুও মাসচারেক ফাদাররা কিছু বলেনি। পাঁচমাসের সময় আমি মিশনের জিনিষ চুরি করে ধরা পড়লাম।” একটি কালো মেয়ের কথা, পৃষ্ঠা ১৫

কাহিনি নির্মাণে তারাশঙ্করের জুড়ি মেলা ভার। তবে এই নির্মাণটি লেখকের অন্যান্য উপন্যাসের মতো নয়। ডেভিডের কথনের মধ্য দিয়ে সব চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। এই আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জাফরুল্লাহ। সে লাহোরের এক খান্দানি পরিবারের লোক। ডেভিডের কোম্পানির অফিসার ছিল, আমোদফুর্তি করেই সময় কাটাত। ক্রিকেট, গানবাজনা, শিকার, বেড়ানোই ছিল তার নেশা। লাহোর-করাচী ও রাওয়ালপিন্ডিতে ঘুরে বেড়াত মনের আনন্দে। জাফরুল্লাহ ১৯৬২ সালের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে নিজে কোম্পানি করার জন্য চলে আসে। জাফরুল্লাহ চরিত্রের মাধ্যমে লেখক তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাপট ও নব্য সামন্ত-মানসিকতা এবং অর্থনৈতিক শোষণের কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। জাফরুল্লাহর চরিত্রের মাধ্যমেই পাঠক কিছুটা আঁচ করতে পারবেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানিরা ছিল অবহেলিত ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয়।

বহেমিয়ান ডেভিড এক দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসে প্রথমে চট্টগ্রাম, পরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে থিতু। সে গায়ক। উর্দু গজল গায়, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করে কোনো মতে চলতে পারে। এ দেশে আসার পর ডেভিড আরও বদলে যায়। মায়ের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পর এদেশের জল-মাটি-বাতাস যেন তাকে দ্রুত বদলে দিতে থাকে। ঢাকা বেতারের ভাওয়াইগান, রবীন্দ্র সংগীতে সে বিমোহিত হয়ে যায় এবং নিজেও এসব গান গাইতে শেখে।

গানপাগল প্রেমিকা হিন্দু মেয়ে ছায়া মূলত ডেভিডের গানের জন্যই পাগল হয়ে যায় এবং প্রেম ও বিয়ের মাধ্যমে দুজনে ঘর বাঁধে। বিয়ের পর ছায়ার উৎসাহে সব ধরনের বাংলা গানও সে শিখে নেয়। রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং অকৃত্রিম মমতায় শিখতে থাকে। নতুন একটি স্বপ্নের ভুবনে তারা জীবনকেও যেন সংগীতময় করে তুলতে যাচ্ছিল। জীবিকার জন্য রেডিও ট্রানজিস্টার মেরামত করে, তৈরিও করে। ছায়ার চরিত্রটিও চিত্রিত হয়েছে মানবিক নারী হিসেবে। ছায়া তাদের বাসার নিচে থাকতে দিয়েছিল এক অন্ধ ভিখারিকে যার সঙ্গে ছিল একটি ছিপছিপে মায়াবী চোখের অধিকারিণী কালো কিশোরী মেয়ে নাজমা। নাজমা গান করত অপূর্ব কণ্ঠে। নাজমার গানের আকর্ষণেই ছায়া ওদের বাড়ির নিচতলায় থাকতে দিয়েছিল। নাজমা কালো হলেও তার শারীরিক গড়ন ও সৌন্দর্য দৃষ্টিকাড়া। যৌবনবতী হলে অন্ধ ভিক্ষুক বাবাকে ফেলে সে এক যুবককে পালিয়ে বিয়ে করে এবং নাজমার একটি পুত্রসন্তান হয়। কিন্তু ছায়া ও ডেভিডের সুখ স্থায়ী হয়নি। ছায়া এক সময় অসুস্থতায় মারা যায়। ছায়ার মৃত্যুর পর প্রেমকাঙাল ডেভিড প্রায় পাগলের মতো হয়ে যায় এবং দুই বছর পর্যন্ত সন্যাসীর মতো দেশের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। ছায়ার প্রতি ডেভিডের প্রেমের গভীরতা যেন লেখকের প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘কবি’র নায়ক কবিয়াল বসনের (বসন্ত) কবিয়াল নিতাইয়ের ছায়া প্রক্ষেপিত হয়েছে।

ছায়া ছিল রাজনৈতিক-সচেতন শিক্ষিতা ও সংস্কৃতিমনা নারী। ডেভিডের ভাষায় সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ করত না, সে ছিল ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। ডেভিডের সওয়াল-জওয়াবের মধ্য দিয়েই লেখক নিপুণভাবে ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু এবং দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধর্মীয় বিভেদের দু-একটি বিষয়ও জুড়ে দেন। ভাষা আন্দোলনের ইস্যুটিকে স্থান দেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও জনরোষের বিষয়টিকে তুলে আনেন। মার্চের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও বাদ পড়েনি। বাদ পড়েনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দু-একটি কথা, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যা পাও হাতের কাছে তাই নিয়ে যুদ্ধ কর। আমাদের সংগ্রাম চলছে-চলবে। আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-আমাদের এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’  উপন্যাসে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকেরও নামও উৎকীর্ণ হয়েছে।

নাজমার স্বামী ২৬শে মার্চের রাতে গুলি খেয়ে মারা যায় এবং পর দিন তার বাবা অন্ধ ভিক্ষুক রহিমও পাকসেনাদের গুলিতে মারা যায়। নাজমার ছেলে চাঁদ ও নাজমাকে বাঁচানোর জন্য ডেভিড ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় পথে পথে নানা রকম বাধাবিপত্তির বর্ণনা ডেভিড দিয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই পাকসেনা, বিহারী ও ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের লোকজন একাট্টা হয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। হিন্দুদের ওপর নৃশংস নির্যাতন অবর্ণনীয়। এইসব অনুষঙ্গ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস পূর্ণতা পায় না। এই আখ্যানেও এ-রকম বর্বরতার কয়েকটি দৃশ্যকল্প চিত্রিত হয়েছে।

তারাশঙ্কর এই আখ্যানে আরেকটি মানবিক, দেশপ্রেমিক ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যে চরিত্রটি এই আখ্যানকে সমৃদ্ধ করেছে। এই চরিত্রটি হলো হাজী আব্বাস, যিনি দেশভাগের আগে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন। একাত্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত জনদরদী ও মানবিক ব্যবসায়ী। তাঁর তিন স্ত্রীর ছয় ছেলে, বড়ো ছেলে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত নেতা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হলো তাঁর বাড়ি। নাজমার ছেলে মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হলে ওদের সে আশ্রয় দেয়।

উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে নারকীয় হত্যাকাণ্ড এবং নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনা। নাজমা হয়ে উঠেছে একাত্তর সালের নির্যাতিতা লক্ষ লক্ষ নারীর প্রতীক। রূপকার্থে একটি বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। থানায় আধমরা নাজমা মাঝে মাঝে কথনের মধ্যে ঢুকেছে তবে তা ছিল কেবল তার উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য। ডেভিড ও নাজমা চরিত্র দুটি পাঠকের মনে দাগ কাটে। বিচিত্র চরিত্র। হাসান আজিজুল হক ভূমিকায় বলেছেন যে, ‘তিরিশের-চল্লিশ দশকের তারাশঙ্করকে এই উপন্যাসে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। এটি এক টানে পড়ে শেষ করা যায়।’

এই উপন্যাসের নির্মাণ ভিন্ন ধারার, চরিত্রগুলো বিচিত্র ভাষা সরল ও সহজবোধ্য হলেও বাংলা ইংরেজি ও উর্দুর মিশ্রণ রয়েছে ডেভিডের সংলাপে যা বেমানান মনে হয়নি। বরং ডেভিডের চরিত্রকে আরও জীবন্ত ও বিশ্বস্ত করে তোলা হয়েছে। সর্বোপরি, বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গ্রন্থকারে প্রকাশিত উপন্যাস হিসেবে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের গবেষণায় এটি অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তারাশঙ্করের অন্যান্য উপন্যাসের ভাষানির্মিতি এবং ন্যারেশনের সঙ্গে অনেক পাঠকের কাছে এই উপন্যাসের কিছুটা খামতি মনে হতে পারে। কিন্তু এর ভিন্ন নির্মাণ কাঠামো, প্রধান চরিত্র ডেভিডের সংলাপের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ উপন্যাস রচিত হওয়ায় এর আবেদন ও মেজাজ পাঠককে পূর্ণ সন্তুষ্টি দিতে সক্ষম। সর্বোপরি বলা যায়, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া গেলেও পাঠককুল এই উপন্যাসে যুদ্ধের পটভূমি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..