ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) মানসিক প্রতিবন্ধী তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আটক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জালাল আহমেদের পারিবারিক কাহিনী খুবই করুণ। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী এই শিক্ষার্থীর পড়াশুনার খরচ চলতো বিভিন্ন জনের দানে। গ্রামের বাড়িতে নেই ঘর বা জায়গা জমিও। মেধাবী এই শিক্ষার্থীর কর্মকাণ্ডে হতবাক স্থানীয়রা। তারাও চান জালাল তার কর্মের জন্য শাস্তি পাক।
শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে ঢাবির পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদের টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার আনেহলা ইউনিয়নের সাইটশৈলা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জালাল ওই গ্রামের আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ছোট ছেলে।
জালালের বাবা-মা ভাইয়ের থাকার মতো কোনো জায়গা জমি নেই। বড় ভাই আল-আমিন তার স্ত্রী নিয়ে অন্যজনের বাড়িতে থাকেন। তার বোনের বিয়ে হয়েছে নারান্দিয়াতে। জালালের প্রতিবন্ধি বাবা আলতাফ অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকেন ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়নের পাথাইলকান্দি এলাকায়। ১৫০০ টাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।
পাথাইলকান্দি বাজারেই তার বাবা-মা চাপড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার পর জালাল এলাকায় বেশি যেতেন না। সরকার পতনের পর জালাল গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে বিভিন্ন বন্ধুর বাড়িতে ৪-৫ দিন ছিলেন। এলাকায় ভদ্র, নম্র ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত জালাল। মেধাবী হওয়ায় গ্রামের মানুষজন তার লেখাপড়ার খরচ যোগান দিয়ে থাকেন।
এছাড়া তার বাবাও যতটুকু পেরেছেন ছেলের পড়াশুনার খরচ দিয়েছেন। সম্প্রতি তার বাবা চাপড়ি বিক্রির ছয় হাজার টাকা দিয়েছিলেন জালালকে। তবে জালাল ঢাকায় কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল কিনা সেটাও জানত না এলাকার মানুষজন, আত্মীয়-স্বজনরা। তার বাবা বিএনপি’র সমর্থক। কিন্তু ছেলে ছাত্রলীগে গিয়েছেন এটাও ঘটনার পরই জেনেছে স্থানীয়রা।
জানা গেছে, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মানসিক প্রতিবন্ধী তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যায় জড়িত জালাল আহমেদ ঘাটাইলের সাইটশৈলা সরকারি প্রাথমিক ও সাইটশৈলা উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করার পর এলেঙ্গার শামছুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাবিতে ভর্তি হন। এরপর থেকেই পরিবর্তন ঘটে জালালের। স্থানীয়দের সহায়তা ও বাবার দেওয়া সামান্য খরচ এবং টিউশনি করে পড়াশুনার খরচ চালানো জালাল এখন হত্যা মামলার আসামি।
স্থানীয়রা জানান, এলাকার মানুষের কাছে জালাল একজন উদাহরণ দেওয়ার মত ছাত্র। কিন্তু একটি ঘটনায় তার এবং তার পরিবারের সমস্ত আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। মেধাবী জালাল এখন খুনের দায়ে পুলিশের হাতে আটক। এলাকার মানুষ টিভিতে না দেখলে এটা বিশ্বাসই করতো না।
সাইটশৈলা গ্রামের কায়কোবাদ হোসেন বলেন, ‘জালাল খুবই মেধাবী ছাত্র। স্থানীয়রা টাকা পয়সা তুলে তার পড়াশুনার খরচ চালিয়েছে। গ্রামে কোনো রাজনীতি করতো না। তার বাবা বিএনপি সমর্থক। তবে ছেলেটা কেন বা কীভাবে রাজনীতিতে গেল সেটা অবাক করার মত। কাউকে এভাবে পিটিয়ে মারবে সে- এটা কল্পনাও করার মত না। ঘটনাটি টেলিভিশনে দেখে হতবাক হয়েছি।’
জালালের বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য
জালালের চাচা চান মিয়া বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। মাঝে মাঝে গ্রামে আসে কিন্তু তেমন কথা হয় না। হঠাৎ গতকাল সাইটশৈলা বাজারের টিভিতে দেখলাম সে একটা ছেলেকে মারধর করছে। এটা ঠিক করেনি। ঘটনার শাস্তি তো সে পাবেই। আমরাও এই ঘটনার শাস্তি চাই।’
জালালের মা কোহিনুর বেগম বলেন, ‘ছেলেকে বুঝিয়েছি অনেক সে যেন কারোর সাথে খারাপ আচরণ বা কাউকে আঘাত না করে। মানুষের সাথে অন্যায় না করতে বারবার বুঝিয়েছি। ঘটনাটি দেখিনি, তবে শুনেছি মেয়ের কাছে। আমার ছেলেকেও যদি এভাবে মারধর করতো তাহলে সেই কষ্টতো আমারও হতো। আল্লাহ তার কপালে সুখ লেখেনি।’
শিক্ষার্থী জালাল আহমেদের বাবা আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সবই আমার ভাগ্য। জায়গা জমি নেই থাকার মত। গ্রামের বাড়ির বাজারে চা বিক্রি করেছি। চা বানানোর জন্য হাতের আঙ্গুল কেটে গেছে। পরে চা আর বিক্রি করতে পারিনি। অন্যের বাড়িতে থেকেছি। পরে পাথাইলকান্দিতে চাপড়ি বিক্রি করি স্ত্রীর সহযোগিতায়। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা কষ্ট করে পড়াশুনা করেছে। অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে। সে চাকরি-বাকরি করবে। আমাদের জন্য না হোক সে যেন পড়াশুনা শেষ করে নিজেই ভালভাবে চলতে পারে। কিন্তু সব কিছুই শেষ হয়ে গেল। আশা ধ্বংস করে দিল এক নিমিষেই। ছেলেকে পুলিশ আটক করেছে শুনেছি। কিন্তু কে তার খোঁজ নেবে? আমিতো প্রতিবন্ধি মানুষ, আমার পরিবারে তেমন কেউ নেই ছেলেটার খোঁজ নেবে। ঢাকায় রাজনীতি করতো কি না তাও জানি না।’
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ছয়জনের মধ্যে জালাল মিয়া ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও হল ছাত্রলীগের সাবেক (সদ্য পদত্যাগকারী) উপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনের চলাকালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোতে সক্রিয় ছিলেন।
Views: 3
Leave a Reply