ওপরের অতিদীর্ঘ শিরোনামের মধ্যে যে দুরূহ তত্ত্বালোচনার প্রতিশ্রুতি রয়েছে বর্তমান প্রবন্ধে তার পরিপূর্ণ মর্যাদা রক্ষিত হবে না। কারণ একটি প্রাচীন বিষয়ের ওপর অযথা সূক্ষ্ম মতামত উদ্ভাবনার দ্বারা ফলহীন কূটতর্ক সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য এখানকার সাহিত্যিকদের জীবনযাত্রা, সাহিত্যসাধনা ও পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রিয়াশীল তার প্রকৃতি বর্ণনা করা, তার বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা। আমাদের লক্ষ্য হবে এমন কতগুলো বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা যার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সমপর্যায়ের অবস্থার কোনো কোনো লক্ষণের একটা প্রাসঙ্গিক তুলনা গোচর করা সম্ভব হয়। অবশ্য এই শেষের কাজটি পশ্চিম পাকিস্তানি আলোচনাকারীদের সহায়তা ভিন্ন সুসিদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়।
যে প্রণালীতে আমরা আমাদের বিচার-বিশ্লেষণে উদ্যোগী হয়েছি তার একটা মৌল সীমাবদ্ধতা আমরা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে চাই। সাহিত্যের রূপ ও রস নিয়ে আমরা আলোচনা করে অভ্যস্ত। কিন্তু কোনো বিশেষ রূপের সাহিত্যের জনপ্রিয়তার প্রকৃতি ও পরিমাণ কী, পাঠকের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্তরগত ভেদাভেদের পরিচয় কী, বিভিন্ন সাহিত্যিকের সৃষ্টিমূলক প্রয়াসের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বাস্তব পরিবেশের জটিলতার স্বরূপ কী এসব বিষয়ে তথ্যভিত্তিক কোনোরকম বৈজ্ঞানিক জরিপকার্যে আমরা এখন পর্যন্ত হাত দেইনি। এই কারণে বর্তমান প্রবন্ধে কেবলমাত্র প্রবন্ধকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুমানকে ভিত্তি করেই একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে।
যে সকল প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে আমাদের ধারণাদি অপেক্ষাকৃত স্পষ্টতা লাভ করেছে সেগুলোকে প্রবন্ধের শিরোনামের আদলে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। এক, পূর্ব পাকিস্তানে যাঁরা লেখেন তাঁদের অসাহিত্যিক পরিচয় কী? জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁরা কী করেন? তাদের সামাজিক ও পারিবারিক আচরণের নমুনা কী? তাদের বয়স কত, শিক্ষাদীক্ষা কী, বসবাস করেন কোথায় ইত্যাদি। দুই, তারা কী লেখেন? গল্প না নাটক, উপন্যাস না ভ্রমণবৃত্তান্ত, প্রবন্ধ না রম্যরচনা? আদর্শবাদী না সুবিধাবাদী, শিল্পী না প্রচারক, আধুনিক না গতানুগতিক, পল্লিপ্রেমিক না নগরাভিমুখী ইত্যাদি। তিন, পাঠকের দাবি কী? কোন রূপ, কোন রস, কোন তত্ত্ব তার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়। পাঠকের শ্রেণি কত রকম, সংখ্যায় কারা বেশি, দাপট বেশি কাদের-ইত্যাদি। বলাবাহুল্য একজনের পক্ষে এসব কথার পুরোপুরি সহি জবাব দেওয়া সম্ভাব তো নয়ই, সহজও নয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেরকম চেষ্টা আপত্তিজনক বলেও মনে হতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা উনিশশ সাতচল্লিশের আগেও বঙ্গ সাহিত্যের সেবা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। এই সাহিত্যিকবর্গের অধিকাংশই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন প্রধানত কবিতার ক্ষেত্রে, মুসলিম পাঠকের জন্য রচিত মুসলিম বিষয়বস্তুর কবিতার ক্ষেত্রে এবং অনেক সময় সে কাব্যপ্রচেষ্টাও সীমাবদ্ধ ছিল পাঠ্যপুস্তক রচনার মধ্যে। ব্যতিক্রম যে নাই তা নয়। যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কিংবা ড. মুহম্মদ এনামুল হক সেকালে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বঙ্গসাহিত্যের সকল প্রকার জ্ঞানান্বেষী পাঠক সমাজের কাছে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র বলে বিবেচিত হতেন। প্রবন্ধকার ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির- এরা বয়সে প্রবীণ হয়েও নব্য মুসলিম বঙ্গের প্রিয়পাত্র। বাংলা কাব্যের ধারায় জসীমউদ্দীনের দান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পনেরো বিশ বছর আগে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। গোলাম মোস্তফার কবিকীর্তিও কেবল পাঠ্যপুস্তক সংকলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এঁরা যখন বিখ্যাত হন আমরা তখন শিশু। এঁদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন পাকিস্তান পূর্ব যুগেও আধুনিক কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
প্রবীণ গদ্য লেখকদের মধ্যে যাঁরা আধুনিকমহলেও আদৃত হতেন তাঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ ও বরকতুল্লাহর নাম সহজেই সকলের মনে পড়বে। উপন্যাস, নাটক ছোটোগল্পে নবীন রীতি ও জীবনবোধের পরিচয় দেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত ওসমান ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন। স্বভাবতই আমাদের এই নামের তালিকা ও শ্রেণীকরণ নিতান্ত অসম্পূর্ণ। পাকিস্তান লাভের ঠিক পূর্ববর্তী অবস্থায় আমাদের বিভিন্ন শ্রেণির সাহিত্যিকদের খ্যাতি ও কর্ম কোন পর্যায়ের ও প্রণালীতে বিস্তার লাভ করেছিল তার একটা অতি ক্ষীণ আভাস মাত্র দেবার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের আসল বর্ণনার বিষয় পূর্বপাকিস্তানের সমকালীন সাহিত্যপট, বিশেষ করে তার গল্প-কবিতা-নাটক উপন্যাসের এলাকা।
পূর্ব পাকিস্তানের নবীনে প্রবীণে যে বিরোধ তা কোনো সময়ই অবদমিত ছিল না। সাহিত্যের বৈঠকে, পত্রিকায়, সংঘে সর্বত্রই এই ব্যবধান একটা আপসহীন নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষিত হয়। সাহিত্যের যে সকল আসরে প্রবীণরা প্রধান সেসব সভা তরুণরা অক্লেশে বর্জন করে চলেন। কিছু পত্রিকা আছে যারা খুঁটি-লেখকদের বয়স পঞ্চাশের উপর, এক আধজনের মাত্র সামান্য নিচে। এসব পত্রিকার ভক্ত পাঠকরাও মুরুব্বীস্থানীয় অথবা গ্রাম-নিবাসী কিংবা ব্যাপকতর অর্থে বিগত যুগের। অপরপক্ষে সাহিত্যের আধুনিক রূপ ও রস প্রচারে ব্রতী সাহিত্যপত্রিকার প্রধান লেখকদের অনেকের বয়সই ত্রিশের নিচে, কয়েকজনের বয়স কিছু ওপরে, দু-একজনের মাত্র চল্লিশ ডিঙিয়ে গেছে। এঁরা আধুনিক এই অর্থে যে এঁদের রসবোধ ও জীবনচেতনা, প্রকাশরীতি ও মানসভঙ্গি, সাক্ষাৎসূত্রে হোক কি পরোক্ষ প্রভাবের ফলেই হোক, সচেতন অনুশীলন কিংবা স্বাভাবিক প্রতিভাবলেই হোক, পশ্চিমের আধুনিক সাহিত্যের মর্মবাণী ও রূপভঙ্গির সমধর্মী।
এই আধুনিক শিল্পী সাহিত্যিকরা বেশিরভাগই রুচিতে পরিমার্জিত নাগরিক, চিন্তাশীলতায় সচেতন জ্ঞানান্বেষী, সাহিত্য সাধনায় মৌলিক ভাব ও নয়া আঙ্গিক উদ্ভাবনে প্রয়াসী। এই জন্যই বিষয়বস্তুর স্থূল মিল আবিষ্কারযোগ্য হলেও নবীন প্রবীণ দুই লেখক পূর্বপাকিস্তানের কোনোমতেই একগোত্রীয় বলে বিবেচিত হতে পারেন না। ইসলামের আদর্শ কিংবা লোকসাহিত্যের উপাদান, দেশাত্মবোধের অনুপ্রেরণা কিংবা প্রেমানুভূতির অন্তরদাহ কোনো কিছুই এই উভয় শ্রেণির লেখকদের রচনার এক তাৎপর্য বহন করে না, একই রসের আবেদন সৃষ্টি করে না। প্রবীণ সন্দেহ করেন যে নবীনদের ঐতিহ্যবোধ স্বদেশপ্রথিত নয়, প্রকাশরীতি অসরল, বক্তব্য অশ্লীল। নবীনরা যখন নির্মম হন তখন প্রবীণদের হালের সাহিত্যসাধনাকে করুণ বা হাস্যকর বিবেচনা করেন। শুনেছি উর্দু সাহিত্য অন্তত কাব্যসাহিত্যে এই পর্যায়ের জাতিভেদ এখনো এতটা মারমূর্তি ধারণ করেনি। সেখানে অনেক জনপ্রিয় কবি রয়েছেন যাঁরা ছেলে-বুড়ো, ছাত্র-কেরানি, পণ্ডিত-অপণ্ডিত সকল মহলেই সমান আদৃত। এটা যেমন সৌভাগ্যের কথা তেমনি দুর্ভাগ্যের কথাও বটে।
আর কিছু নয় কেবল লিখে সংসার চালান এমন লোক পূর্ব পাকিস্তানের নেই বললেই চলে। অবশ্য বটতলার শোভাবর্ধনকারী প্রেমের উত্তেজনাপূর্ণ কেচ্ছা ও রহস্যময় রোমাঞ্চকর সিরিজের রচনাকারীদের কথা স্বতন্ত্র। তারা অনেক লিখেও লেখক নয়। বাদবাকি প্রায় সকল সাহিত্যিকই জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো না কোনো অসাহিত্যিক কর্মে নিযুক্ত। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা তার মধ্যে সর্বপ্রধান। চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করবার আগে গোলাম মোস্তফা শিক্ষকতা করেছেন, জসীমউদ্দীন স্বল্পকালের জন্য হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার কাজ করেছেন। ‘প্রিন্সিপাল’ তো ইব্রাহিম খাঁর নামের আগে বলে পরিগণিত। শওকত ওসমান ও শাহেদ আলী, সৈয়দ আলী আহসান ও সৈয়দ আলী আশরাফ, নুরুল মোমেন ও অশকার ইবনে শাইখ, মুনির চৌধুরী ও আশরাফ সিদ্দিকী সবাই অধ্যাপক। প্রথম বৎসর নাটকের জন্য যিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন তার পেশাও ছিল অধ্যাপনা। এরপরই বোধ হয় বেতার কেন্দ্র, সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকার অফিসের স্থান। দ্বিতীয় বৎসর আদমজী পুরস্কারপ্রাপ্ত দুজনের মধ্যে একজন সাংবাদিক। দেশি-বিদেশি সরকারি প্রচার দপ্তর কিংবা পয়সাওয়ালা দু-একটা পুস্তক প্রকাশক প্রতিষ্ঠানকেও এই শ্রেণিভুক্ত করা যেতে পারে।
এই পর্যায়ের চাকুরিজীবী লেখকরা হয় সামান্য বেতনের বেশি খাটেন, নয় বেশি বেতনের বিনিময়ে স্বাধীনতা হারান। কারণ যাই হোক না কেন, এঁরা এঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে অসন্তুষ্ট এবং ঘনঘন অফিস বদল করেন। স্বাধীন ব্যবসায়রত বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও সাহিত্যচর্চা করেন এমন লোক পূর্ব পাকিস্তানের কম, কিন্তু একেবারে যে নেই তা নয়। পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক সাহেব সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক এবং ব্যবসায়ী দুইই। বর্তমানে বৎসরের আদমজী পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন উপন্যাসিক কোনো এক তেল কোম্পানির অফিসার। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা সাহিত্য সাধনা করেন না। সবেমাত্র ব্যতিক্রম দেখা দিতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের দুজন সিএসপি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে অনেক দিন থেকেই স্বনামখ্যাত।
জজ-ব্যারিস্টার কি মুনসেফ হাকিমদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য নাম নেই। এমনকি হালের দু’একজন অতি নবীন প্রবন্ধকার ও গল্প লেখক ব্যতীত ডাক্তাররাও রোগীর ও নিজের ব্যবস্থা করা ছাড়া অন্য কিছু করেন না। আমাদের কূটনৈতিক মিশনের বিজ্ঞব্যক্তিরাও সৃষ্টিহীন। এক ব্যতিক্রম ফরাসি ললনার পাণি-গ্রহণকারী বার্লিনে প্রেরিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ইতালির শহর রোমে গিয়েছিলেন নিজের গরজে। গরজ না মিটলে ফিরবেন এমন মনে হয় না।
পূর্বপাকিস্তানি শিল্পী সাহিত্যিকদের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁরা সবাই নাগরিক হিসেবে ষোল আনা স্বাভাবিক। সাংসারিক দায়িত্বপালনে তাঁরা উদাসীন নন, সামাজিক ক্রিয়াকর্মে তাঁরা পাড়া-প্রতিবেশীর উৎসাহী সহযোগী। শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান চরিত্রবান বলিষ্ঠ পুরুষ। সিনেমা বা রেডিওর খ্যাতনামা গায়িকারাও সুশিক্ষিতা ও সুরুচিসম্পন্না, অনেকে সুমাতা ও সুগৃহিণীও বটে। সাহিত্যিকদের তো কথাই নেই। পড়ালেখা করেন, ঘর সংসারের দিকেও নজর রাখেন। উপযুক্ত বয়সে বিবাহ করেন এবং সন্তানাদি হলে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হন। পোশাক পরিচ্ছদে বা চালচলনে একটা ছন্নছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করা তাঁর স্বভাব নয়। এখনকার সমাজে সেরকম প্রত্যাশাও করে না। শুনেছি পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্যিকদের, বিশেষ করে কবিদের জীবন সকল ক্ষেত্রে গৃহীত অর্থে এতটা নিষ্কলুষ নয় এবং সমাজ নাকি কবিদের অসাধারণ আচরণকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়।
কবিদের প্রসঙ্গে তুলনামূলক মন্তব্য আরো একাধিক অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। শুনেছি পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্যজগতের সেরা ব্যক্তিরা হলেন কবি। তাঁরা সংখ্যায় বেশি এবং জনপ্রিয়তায় সর্বজয়ী। এই প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে অনেকটা উর্দু ভাষার নিজস্ব একটি গুণের জন্য। যে সাহিত্য মুখে মুখে প্রচারিত হবার যোগ্যতা রাখে তার আবেদনের ব্যাপ্তি গণ্ডিবদ্ধ থাকতে পারে না, সমাজের একাধিক কৃত্রিম শ্রেণি শৃঙ্খলকে লঙ্ঘন করে সর্বস্তরে পরিপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে। উর্দু ভাষার কবিতা সুর করে শোনানো হয়, আসর করে উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করা হয়। ভালো চরণে বাহবা পড়লে তার পুনরাবৃত্তি করা হয়। এক এক আসরে শতসহস্র পাঁচমিশালি লোক এক এক কবিকে হৃদয়ে গ্রহণ করবার আনন্দময় অবকাশ পায়। ভালো কবি দেশবরেণ্য হয়ে ওঠেন। এ সৌভাগ্য থেকে বাঙালি কবি যত ভালোই হন না কেন বঞ্চিত। তার কবিতা ছাপার পুথি। তার ওপর আধুনিক কবির ভাষা সর্বাঙ্গীনভাবে আধুনিক। জনসমষ্টিকে সম্বোধন করে তিনি কথা বলেন না। তার বাণী বিশিষ্ট পাঠকের জন্য সযত্নে নির্মিত, সচেতন কারুকুশলতা ও স্বাভাবিক মননশীলতার দ্বারা ঐশ্বর্যমণ্ডিত পূর্বপাকিস্তানের তাই কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক কবিরা নিজে অথবা তাদের কোনো গুণমুগ্ধ ব্যবসায়ী যিনি লাভের আশা নেই জেনেও নিছক সাহিত্য সেবা ও সুহৃদপ্রীতির নিদর্শনস্বরূপ ওই কাজে হাত দেন। তবে একটা কথা। পূর্ব পাকিস্তানের কবি হয়তো জনগণমন অধিনায়ক না হতে পারেন কিন্তু তিনি পানাশক্ত উদাসী বলে পারিপার্শ্বিক সমাজে ও পরিবারে পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হন না।
পূর্বপাকিস্তানে উপন্যাসের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। তারপর ছোটোগল্প ও নাটকের স্থান। বছরে গড়ে যে ৫০খানা উল্লেখযোগ্য নতুন বই প্রকাশিত হয় তার দুই তৃতীয়াংশ গল্প-উপন্যাস। এর মধ্যে যেগুলো পাঠকচিত্ত স্পর্শ করে বছরে তার এক হাজার করে কপি বিক্রি হতে পারে। প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিক বইপ্রতি পাঁচ বছরে দু’তিন হাজার করে টাকা মুনাফা পেতেও পারেন। তবে এদের সংখ্যা চার-পাঁচজনের বেশি হবে কিনা সন্দেহ। অবশ্য কোনো কোনো প্রাচীন লেখকের বই প্রচুর বিক্রি হয়। তার একমাত্র কারণ রচনার উৎকর্ষ নয়। কখনো বই বেশি বিক্রি হয় কারণ তার বিক্রির ব্যবস্থাটি উত্তমরূপে সংঘটিত অথবা এই কারণে যে তার আস্বাদন লাভে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর অনড় অচল গতানুগতিক চেতনার ক্ষমতাধীন।
রম্যরচনা জাতীয় এক সংকরবস্তু হালে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় গদ্যসাহিত্য রূপে বাজার দখল করার পথে ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে এসে ভ্রমণবৃত্তান্তমূলক খোসগল্প রচনা করবার প্রবৃত্তি সহজাত। আর ইউরোপ আমেরিকা যাচ্ছেনও অনেক লোক। যারা অন্যত্র যাচ্ছেন বা আদৌ কোথাও যাচ্ছেন না তারাও লিখছেন। এ জাতীয় রচনার কাটতি এতই বেশি।
পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্যিক-সংঘ হয়তো অনেক আছে কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে কোনো নীতি বা আদর্শ বা ধারণা প্রচার করবার জন্য কোনো প্রয়াস লক্ষণীয় নয়। এই জন্যই এখানকার সাহিত্যিকদের উত্তর-দক্ষিণ নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে বিচার করা অসঙ্গত। প্রায় সকলের মধ্যেই দলগত চিন্তার সংস্পর্শ একটু আধটু যদি থাকেও, ব্যক্তিগত সংস্কার স্বপ্ন বাসনায় প্রবলতম। শুনেছি, দেশ জাতি ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ের উপর উর্দুতে যথেষ্ট কবিতা রচিত হয় এবং সেসব রচনায় বিভিন্ন গোষ্ঠীগত চিন্তা ও তত্ত্ববস্তু প্রতিফলিত হয়।
পূর্বপাকিস্তানে সাহিত্যিকের সঙ্গে সাহিত্য ও পাঠকের প্রাচীন সম্পর্ক বর্তমানে কয়েকটি বিশেষ কারণে রূপান্তরিত হতে চলেছে। তার মধ্যে প্রধানতম হলো সাহিত্যিকের আর্থিক স্বচ্ছলতার পথ সুগম হওয়া। সরকারি ও বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান আজকাল সাহিত্যিকদের তুষ্ট ও পুরস্কৃত করতে আগ্রহশীল। বলাবাহুল্য সাহিত্যিকের আর্থিক সৌভাগ্যের সূচনা সাহিত্যিককে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে, তার পারিবারিক জীবনে স্বচ্ছলতা আনে, নানাভাবে তার ব্যক্তিত্বকে মর্যাদাবান করে তোলে। সাহিত্যিকের অবসর প্রশস্ততর হয়, চিত্ত অধিকতর আনন্দিত থাকে। এ সবই সৃষ্টিকর্মের বিশেষ অনুকূল সন্দেহ নেই। তবে এই সৌভাগ্য অবিমিশ্র নয়। কারণ সাহিত্যিককে যাঁরা অর্থদান করেন তারা কিছু প্রতিদানের ও প্রত্যাশী। জনতার দাবি মেটাবার জন্য প্রকাশক ও প্রযোজক লেখককে টাকা সাধেন। দেশের হিত সাধনের জন্য সরকার লেখককে গঠনমূলক রচনার আত্মনিয়োগ করবার জন্য আহ্বান জানান। সব দিক থেকেই লেখক লাভবান হন এবং ক্রমশ ফরমায়েশি লেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। হলে তা সৌভাগ্যের কথা নয়।
ভূমিকা :
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) বাংলাদেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে অবিস্মরণীয় নাম। প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী বহুমাত্রিক এই লেখক, অধ্যাপক ছিলেন কুশলী বক্তা, সফল নাট্যপ্রতিভা, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক। মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যে কয়েকজন সৃজনশীল লেখক বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানপন্থী ঘাতকদের নির্মমতায় শহীদ হন, তিনি তাদের অন্যতম। স্বাধীনতার পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সময়পর্বে প্রফেসর আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি চার খণ্ডে প্রকাশ করে মুনীর চৌধুরী রচনাবলি।
এর পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ ২০০১ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে ‘মুনীর চৌধুরী রচনাসমগ্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানে এখনো মুনীর চৌধুরীর অগ্রন্থিত রচনার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। তেমনি একটি অগ্রন্থিত রচনা ‘পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্য: পাঠক-সাহিত্যিক সম্পর্ক’।
এই প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম সম্পাদিত মাসিক ‘পূবালী’ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যায় (বৈশাখ ১৩৬৯/এপ্রিল ১৯৬২)। পত্রিকায় মুদ্রিত তথ্য থেকে জানা যায় মুনীর চৌধুরী এ প্রবন্ধটি একটি সেমিনারে পাঠ করেছিলেন। প্রবন্ধটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিকদের জীবনযাত্রা, সাহিত্য সাধনা ও পাঠকগোষ্ঠীর মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রিয়াশীল তার প্রকৃতি বর্ণনা ও বৈশিষ্ট্য নিরূপণে লেখকের প্রয়াস লক্ষণীয়। এ বিষয়ে লেখক যে বিচার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন তা এখনো অনেকাংশেই প্রাসঙ্গিক।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে শহীদ মুনীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রবন্ধটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো।
এখানে প্রকাশের সময় লেখাটিতে বর্তমানে প্রচলিত বানান রীতি ব্যবহার করা হয়েছে।
Views: 42
Leave a Reply