জসপ্রিত বুমরাহ পেছনে ফিরে তাকাতে চাইলেন না! তার মুখ হাত দিয়ে ঢাকা। চোখকেও বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না কয়েক সেকেন্ড আগে কি ঘটে গেল? শুধু-ই কি তার অবয়ব? নাকি ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে হাজির হওয়া ৩৩ হাজার দর্শকের একই চেহারায়, একই অনুভূতি? কেবল কি ওই নীল সমুদ্রে শামিল হওয়া দর্শকরা…নাকি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভারতীয়দের হৃদয় মোচড় দিয়ে গেল ওই মুহূর্ত! তাহলে কি মোহাম্মদ সামি বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলেন?
কিন্তু মেরিন ড্রাইভের পাশে কৃত্রিম আলোয় জেগে থাকা নক আউট পর্বের ম্যাচে হুট করেই আকাশী শিবিরে কালো মেঘের আনাগোনা। মাত্র দশ বলের ম্যাচে দুই ওপেনার কনওয়ে ও রাচিনকে ফেরানোর পরও দুশ্চিন্তা ওয়াংখেড়েতে। কেননা কেন উইলিয়ামসন ও ডার্ল মিচেল যে ততক্ষণে প্রতি আক্রমণে অনায়াসে রান তুলে যাচ্ছিলেন। সেঞ্চুরি পাওয়া ডার্ল মিচেলের এক সময় মনেও হয়েছিল, ‘যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তাতে মনে হচ্ছিল ১০ ওভার আগে জিতে যেতে পারি।’
ওই ভাবনা আর মনের বিশ্বাস থেকে ভারতের একেক বোলারকে তুলোধুনো করছিলেন মিচেল। তাকে সঙ্গ দিয়ে উইলিয়ামসনও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ভারতের মাঠে বসে ভারতের খেলা দেখার ভিন্ন রকম এক অভিজ্ঞতা আছে। আপনি যদি মাঠে পিনপতন নিরাবতা পান তাহলে বুঝবেন মাঠে ভারত খেলছে না। আর যদি উৎসবে মাততে দেখেন তাহলে বুঝবেন সব কিছু ভারতের পক্ষে যাচ্ছে। উইলিয়ামসন ও মিচেল যখন ছুঁড়ি চালাচ্ছিলেন তখন এমনই অভিজ্ঞতা হয়।
কিন্তু ভারতের তো একজন সামি আছে। ক্যাচ নিতে না পারলেও উইকেট তো নিতে পারেন। সামির হাতে কেবল ছিল ৬ ওভার। উইলিয়ামসনের ক্যাচ ছাড়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ওই ৬ ওভার কি যথেষ্ট? কিন্তু দ্রুতগতির পেসার মুগ্ধতা ছড়ালেন। পেস বোলিংয়ের প্রেমে বুদ করে রাখলেন। নিজের করা পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলে পেয়ে গেলেন সেই উইলিয়ামসনের উইকেট।
ক্যাচ মিসের ৩ ওভার পর বোলিংয়ে এসে পেয়ে যান অরাধ্য সাফল্য। ভাঙেন উইলিয়ামসন ও মিচেলের গড়া ১৪৯ বলে ১৮১ রানের জুটি। এক বল পর তার শিকার টম লাথাম। ব্যস! আর কি লাগে। শুরুর স্পেলে ১০ বলে ২ উইকেট। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে ৩ বলে ৩ উইকেট। তাতেই সাফল্যের রসদ পেয়ে যায় ভারত। ফাইনালের টিকিটের সুবাতাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
ডেথ ওভারে পুরোনো বলে ফিরে আরো ভয়ংকর রূপে সামি। এবার তার শিকার বড় তারকা মিচেল। সেঞ্চুরি করে ভারতকে ভয় দেখানো এ ব্যাটসম্যানকে মিড উইকেটে জাদেজার হাতে তালুবন্দি করান। মাঝে জয়ের সুবাতাস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সামি, শেষে এসে পুরো বাগানই ওয়াংখেড়েকে উপহার দেন। তবে তার পাওয়ার ছিল আরো কিছু। টিম সাউদি, লোকি ফার্গুসনকে ফিরিয়ে প্রথম বোলার হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ৭ উইকেট নেওয়ার অনন্য কীর্তি গড়েন।
সামি যখন মিচেলকে ফিরিয়ে পঞ্চম উইকেট পান তখন মাঠে বিরাট কোহলি দাঁড়িয়ে ছিলেন লং অফে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে বিরাট বলতে থাকেন, সামির জন্য চিৎকার করতে। মুহূর্তেই ওয়াংখেড়ের গ্যালারিতে ভেসে আসে ‘সামি…সামি…সামি।’
ধর্মশালায় বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই তার শিকার ৫ উইকেট। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ওই সময়ে নিউ জিল্যান্ড ছিল দাপুটে। টানা চার জয়ে তারা উড়ছিল। সেই দলের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিয়ে সামি বিশ্বকাপে আগামণী বার্তার জানান দেন। পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবার তার শিকার ৪ উইকেট। এক ম্যাচ পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়াংখেড়েতে তার বোলিং ফিগার ছিল ১৮ রানে ৫ উইকেট। বেঙ্গালুরুতে শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে উইকেটশূন্য থাকলেও ওয়াংখেড়েতে সেমি-ফাইনালে ফিরে সামি যা করলেন তা মনে থাকবে অনন্তকাল। ৫৭ রানে ৭ উইকেট। বিশ্বমঞ্চে যে কোনো বোলারের জন্য স্বপ্নের মতো। সামি সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন অসাধারণ বোলিংয়ে।
আর ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য সামির ট্রেডমার্ক সুইং ডেলিভারী তো আছেই। বল কখনো ভেতরে ঢোকান। কখনো আউটসাইড অফ দিয়ে বাইরে নিয়ে যান। লেন্থ ডেলিভারীও এমনভাবে হিট করান তাতে ব্যাটসম্যানরা শট খেলতে গিয়ে অনেক সময় উইকেট দিয়ে বসেন। সারা বছর দ্বিপক্ষীয় সিরিজ, আইপিএল ও ঘরোয়া লিগ খেলায় উইকেটের খুঁনিনাটি সব জানেন। সেসবই এবার কাজে লাগিয়েছেন এই দ্রুতগতির বোলার।
ম্যাচ শেষে কথার ঝাঁপি খুলে দেন সামি। কেন উইলিয়াসমনের ক্যাচ ছাড়া এবং কিভাবে নিউ জিল্যান্ডকে আটকে রেখেছেন সব বলেছেন মন খুলে, ‘আমি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি খুব বেশি সাদা বলের ক্রিকেট খেলিনি। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ধর্মশালায় খেলা শুরু করেছিলাম। বোলিংয়ে বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। আমি এখনও বিশ্বাস করি নতুন বলে উইকেটে হিট করে উইকেটে সফলতা পাওয়া সম্ভব।’
‘আমি উইলিয়ামসনের ক্যাচ ধরতে পারিনি। এটা করা একদমই উচিত হয়নি। খুবই মর্মাহত। কিন্তু আমার মনোযোগ ছিল নিজে ভালো বোলিং করে পুষিয়ে নেব। উইকেট ভালো থাকায় গতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করি। গতি কমিয়ে দিয়েছিলাম। উইকেটে ঘাস ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। তবে শিশির না থাকায় সুবিধা হয়েছে। শিশির থাকলে হয়তো এই রান তাড়া করে ফেলত।’
‘অসাধারণ লাগছে নিজের পারফরম্যান্সে (৫৭ রানে ৭ উইকেট)। শেষ দুটি বিশ্বকাপে আমরা সেমি-ফাইনালে বাদ পড়েছিলাম। কে জানে ভবিষ্যতে আবার আমরা সুযোগ পাই কিনা খেলার। এজন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। এই সুযোগটি আমরা হাতছাড়া করতে পারি না।’-যোগ করেন সামি।
ক্যারিয়ারে স্বর্ণসময় পার করা সামি নিজেকে এখনই নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে তার সাফল্য আকাশে পূর্ণতা আসবে। ১৯ নভেম্বর ফাইনালে তার আরেকটি বিধ্বংসী পারফরম্যান্সে কাজটা সহজ হয়ে যায়। সেই মুহূর্তটাই দেখার অপেক্ষায়।
Views: 4
Leave a Reply