সুস্বাস্থ্যের জন্য উৎকৃষ্ট ব্যায়াম হলো হাঁটা। হাঁটলেই শরীর থাকবে সুস্থ। যান্ত্রিক জীবনে জ্যামের মধ্যে অলসভাবে সবার সময় কাটে। এতে করে শরীরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
চিকিৎসকদের মতে, কয়েক পা হাঁটার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সুস্থতার চাবিকাঠি। প্রতিদিন হাঁটলে শুধু শরীর ভাল থাকে তা নয়, ভালো থাকে মন, আয়ুও বাড়ে। হাঁটাহাঁটি করলে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়। মন এবং মস্তিষ্ক দুই-ই ফুরফুরে হয়।
ব্রিটিশ জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, প্রতিদিন দ্রুত গতিতে ১১ মিনিট হাঁটলেই অকালমৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে ঠেকিয়ে রাখা যায়।
যে কোনো মাঝারি-তীব্র শারীরিক কার্যকলাপ প্রতিদিন অন্তত ১১ মিনিট কিংবা প্রতি সপ্তাহে সময় বের করে ৭৫ মিনিট করতে পারলেই হৃদ্রোগ, স্ট্রোক এবং ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে— এমনটাই বলা হয়েছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সেই গবেষণায়।
মাঝারি থেকে তীব্র গতির শরীরচর্চা একজনের হৃদ্স্পন্দন বাড়িয়ে তোলে এবং দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সাহায্য করে। সহজ কিছু শরীরচর্চা বেছে নিলেই মৃত্যুঝুঁকি এড়ানো যায়। মাঝারি ও তীব্র গতির শরীরচর্চাগুলোর মধ্যে দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো, হাইকিং, নাচ এবং টেনিস বা ব্যাডমিন্টনের মতো খেলাও প্রতিদিনের রুটিনে সংযোজন করতে পারেন।
গবেষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হৃদ্রোগ এবং স্ট্রোকের মতো কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে ১৭.৯ মিলিয়ান (১ কোটি ৭৯ লক্ষ) মানুষ মারা যান। ২০১৭ সালে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ান (৯৬ লক্ষ) মানুষ ক্যানসারে প্রাণ হারিয়েছেন।
গবেষকদের দাবি, সপ্তাহে ৭৫ মিনিট মাঝারি থেকে তীব্র গতির শরীরচর্চা অকালে মৃত্যুর ঝুঁকি ২৩ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। সপ্তাহে ১৫০ মিনিট শরীরচর্চা করতে পারলে আরও ভালো ফলাফল প্রত্যাশিত। প্রথমে সপ্তাহে ৭৫ মিনিট করে শুরু করলেই হবে, তারপর আপনা থেকেই ধীরে ধীরে সময় বাড়ানোর তাগিদ আসবে বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
সপ্তাহে ৭৫ মিনিট শরীরচর্চা করে হার্টের রোগের ঝুঁকি ১৭ শতাংশ কমে এবং ক্যানসারের মতো মারণরোগের ঝুঁকি কমে ৭ শতাংশ । এই প্রকার শরীরচর্চা ঘাড় ও গলার ক্যানসার, গ্যাস্ট্রিক ক্যানসার, কার্ডিয়াক ক্যানসার, লিউকিমিয়ার মতো রোগের ঝুঁকি প্রায় ১৪ থেকে ২৬ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে।
দুপুরের খাবার বা রাতের খাবার খাওয়ার পর ১১ মিনিট হাঁটলে রক্তে শর্করা মাত্রা কম হতে পারে। এমনকি, যারা প্রত্যেকদিন ৪৫ মিনিট করে সকালে হাঁটছেন, তারা যদি একটানা অতক্ষণ না হেঁটে প্রত্যেকটা মিলের পর ১১ মিনিট করে হাঁটতে পারেন, তাহলে বেশি উপকার পাবেন।
প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যেকদিন অন্তত ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করা উচিত। কিন্তু অনেকেই সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন না। ওজন ঝরানোর জন্য শুধু ১১ মিনিট হাঁটলে চলবে না। তবে যে ক্যালোরিগুলো এমনি ঝরবে না, সেগুলো ঝরানোর জন্য ১১ মিনিটও যথেষ্ট। চলুন হাঁটার কিছু উপকারিতা জেনে নিই।
হার্ট ভালো থাকে
চিকিৎসকদের মতে, প্রতি সপ্তাহে মাত্র আড়াই ঘণ্টা হাঁটলেই নাকি হার্টের অনেক সমস্যার সমাধান হয়। অর্থাৎ, দিনে যদি মাত্র ২১ মিনিট হাঁটাহাঁটি করেন, তাহলে আপনার হার্ট তো ভালো থাকবেই, সেই সঙ্গে হৃদরোগের আশঙ্কাও কমবে। নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে।
ওজন কমায়
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাঁটার জুড়ি মেলা ভার। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস চর্বি কমাতে সাহায্য করে। চিকিৎসকরা রোগা হওয়ার পর্বে হাঁটার পরামর্শ করে দেন। কিন্তু কাজটা অতটাও সহজ নয়। রীতিমতো ঘাম ঝরিয়ে দ্রুত পায়ে একই গতিতে হাঁটা, ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই হাঁটার সময়ে গতি কমালে চলবে না। তবে প্রতিদিন যদি কিছুটা সময় হাঁটাচলা করা যায়, তা হলে শরীর এমনিতে অনেক হালকা থাকবে।
উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন অনেকেই। ওষুধ খেয়ে, খাওয়াদাওয়ায় নিয়ম মেনেও সব সময়ে বশে রাখা যায় না উচ্চ রক্তচাপ। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, নিয়ম করে যদি হাঁটা যায়, তা হলে রক্তচাপের মাত্রা অনেকটাই বশে রাখা সম্ভব। হাঁটলে রক্তচাপ কমে। এমনকি, অনেকের ওষুধ খাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ডায়াবেটিসের হাত ধরেই জন্ম নেয় আরও অনেক শারীরিক সমস্যা। তাই রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে রেহাই পাবেন অনেক শারীরিক সমস্যা থেকে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে হাঁটার ভূমিকা অপরিসীম।
তবে ডায়াবেটিস থাকলে হাঁটতেও হবে নিয়ম মেনে। প্রথমে ধীর গতিতে শুরু করতে হবে। তিন থেকে পাঁচ মিনিট ধীরপায়ে হাঁটার পর গতি বাড়াতে হবে। মাঝারি গতিতে পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর্যন্ত হাঁটতে হবে। টাইপ টু-র ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এ ভাবে হাঁটাহাঁটি স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ ভাল।
মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধি করে
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে তিনবার এক ঘণ্টা দ্রুত হাঁটেন তাদের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যারা শিক্ষা সেমিনারে অংশ নেয় তাদের তুলনায় ভালো। অন্যান্য গবেষণা দেখায় যে শারীরিক ব্যায়াম, যেমন হাঁটা, বয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, নিয়মিত হাঁটার ফলে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে এই সুবিধাগুলো পাওয়া যায়। তাই যখন হাঁটা-চলা করবেন, তখন আপনার মস্তিষ্কও ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করবে।
মন ভালো থাকে
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন হাঁটলে তা স্নায়ু প্রক্রিয়া ঠিক রাখে, যা আপনার রাগ এবং আক্রমণাত্মক আচরণকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। সকালের রোদে হাঁটা মনের জন্য আরো ভালো যা আপনাকে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি দেয়। সর্বোপরি হাঁটতে বের হলে আপনি আশেপাশের মানুষের সাথেও দেখা, সাক্ষাৎ ও গল্প করতে পারেন; যা মনের জন্য অনেক ভালো।
শক্তি বৃদ্ধি করে
বহু মানুষের শরীরে এনার্জির (শক্তির) ঘাটতি থাকে। তাই তারা সারা দিন ক্লান্ত অনুভব করেন। এই পরিস্থিতি জীবনকে জটিলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। নিয়মিত হাঁটা শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে শরীরকে সুস্থ রাখে।
আয়ু বাড়ায়
হাঁটা-চলা আপনার জীবনীশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কারণ এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, যারা প্রতি সপ্তাহে মাত্র ১০ থেকে ৫৯ মিনিট হাঁটাহাঁটি করেন, অলস ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি ১৮শতাংশ কম।
হাড় ও পেশির শক্তি বৃদ্ধি
নিয়মিত হাঁটা শরীরের জন্য যেমন উপকারী তেমনি পেশি ও হাড়ের শক্তি বৃদ্ধি পায় কয়েক গুণ। তাই নিয়মিত হাঁটতে হবে। তবেই আপনার সুস্থ থাকার পথ প্রশস্ত হবে।
Views: 48
Leave a Reply